১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াতে ইসলামীর আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে রায় ঘোষণার জন্য আগামীকাল মঙ্গলবার দিন নির্ধারণ করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।
এর আগে রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে তুমুল যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হয়। এসময় নিজামীর বিরুদ্ধে মোট ১৬টি অভিযোগের উপর যুক্তিতর্ক চলে। পরে মামলাটি সর্বমোট তিনবার অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখা হয়।
রাষ্ট্রপক্ষের অভিযোগপত্র অনুসারে নিজামীর বিরুদ্ধে ১৬টি অভিযোগে গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩(২)(এ), ৩(২)(সি), ৩(২)(জি), ৩(২)(এইচ), ৪(১), ৪(২) ধারা অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, লুট, ধর্ষণ, উষ্কানি ও সহায়তা, পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র এবং বুদ্ধিজীবী হত্যার উপর এসব অভিযোগ আনা হয়েছে। এছাড়াও এ আইনের ৪(১) ও ৪(২) ধারায় অনুযায়ী বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা ও সুপিরিয়র রিসপনসিবিলিটির (ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের দায়) অভিযোগ রয়েছে নিজামীর বিরুদ্ধে।
নিজামীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের ১৬ অভিযোগ হলো:
প্রথম অভিযোগ:
পাবনা জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক মাওলানা কছিমুদ্দিনকে নির্যাতন করে হত্যা। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচার চালাতেন। একাত্তরের ৪ জুন পাকিস্তানি সেনারা তাকে অপহরণ করে নূরপুর পাওয়ার হাউসের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে নিজামীর উপস্থিতিতে তার ওপর নির্যাতন চালানো হয়। ১০ জুন তাকে ইছামতি নদীর পাড়ে অন্যান্য ব্যক্তির সঙ্গে হত্যা করা হয়।
দ্বিতীয় অভিযোগ:
একাত্তরের ১০ মে বেলা ১১টার দিকে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার বাউশগাড়ি গ্রামের রূপসী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। স্থানীয় শান্তি কমিটির সদস্য ও রাজাকারদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত ওই সভায় নিজামী বলেন, ‘শিগগিরই পাকিস্তানি সেনারা শান্তি রক্ষার জন্য আসবে।’ ওই সভার পরিকল্পনা অনুসারে পরে বাউশগাড়িসহ দু’টি গ্রামের প্রায় সাড়ে ৪০০ মানুষকে পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করে। প্রায় ৩০ থেকে ৪০ নারীকে ধর্ষণ করে রাজাকাররা।
তৃতীয় অভিযোগ:
একাত্তরের মে মাসের শুরু থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোহাম্মদপুরের ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প ছিল। রাজাকার ও আলবদর বাহিনীও সেখানে ক্যাম্প স্থাপন করে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালাতে থাকে। নিজামী ওই ক্যাম্পে নিয়মিত যাতায়াত ও মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র করতেন।
চতুর্থ অভিযোগ:
একাত্তরের ৯ ও ১০ সেপ্টেম্বর যশোর বিডি হলে ছাত্রসংঘের মিটিংয়ে জিহাদের সমর্থনে আল কোরআনের একটি আয়াত উল্লেখ করে বক্তব্য দেন নিজামী। ওই মিটিংয়ে বক্তব্য দিয়ে নিরীহ বাঙালি হত্যার নির্দেশ দেন তিনি।
পঞ্চম অভিযোগ:
একই বছরের ১৪ মে নিজামীর নেতৃত্বে পাকিস্তান সেনাবাহিনী, রাজাকার, আলবদররা পাবনার ডেমরা ও বাউসগাড়ি গ্রাম ঘেরাও করে। এরপর সাড়ে চারশ হিন্দুকে এক জায়গায় জড়ো করে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করে। সেখানে নারীদের ধর্ষণও করা হয়।
ষষ্ঠ অভিযোগ:
নিজামীর নির্দেশে পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগিতায় একই বছরের ৮ মে পাবনার সাঁথিয়া থানার করমজা গ্রামে সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ অসংখ্য লোককে হত্যা এবং কয়েকজন মহিলাকে ধর্ষণ করা হয়।
সপ্তম অভিযোগ:
একই বছরের ২৭ ও ২৮ নভেম্বর পাবনার সাঁথিয়া থানার ধোলাউড়ি গ্রামে ডা. আবদুল আওয়ালের বাড়ি ও আশপাশের বাড়িতে হামলা চালিয়ে ৩০ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সেখান থেকে আটক চারজনকে ইছামতি নদীর পাড়ে নিয়ে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়। তাদের একজন শাহজাহান আলীকে জবাই করে ফেলে যায় রাজাকাররা। ভাগ্যক্রমে শাহজাহান আলী বেঁচে যান।
অষ্টম অভিযোগ:
১৬ এপ্রিল ঈশ্বরদী থানার আটপাড়া ও বুথেরগাড়ি গ্রামে হামলা চালিয়ে ১৯ জনকে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়।
নবম অভিযোগ:
১০ জুন আতাইকুলা থানার মাতপুর গ্রামের মাওলানা কছিমউদ্দিনকে আটকের পর ইছামতি নদীর পাড়ে নিয়ে হত্যা করা হয়।
দশম অভিযোগ:
পাবনার সোনাতলা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা অনিল চন্দ্র কুণ্ডু প্রাণ বাঁচাতে ভারতে চলে যান। নিজামীর নির্দেশে রাজাকাররা তার বাড়ি আগুনে জ্বালিয়ে দেয়। অষ্টম অভিযোগে বলা হয়, ৩০ আগস্ট নিজামী নাখালপাড়ার পুরোনো এমপি হোস্টেলে গিয়ে সেখানে আটক রুমী, বদি, জালালদের হত্যার জন্য পাকিস্তানি সেনাদের প্ররোচনা দেন।
নিজামীর বিরুদ্ধে ১১, ১২, ১৩ ও ১৪ নম্বর অভিযোগ:
তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে উসকানি দেয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে। এসব অভিযোগে বলা হয়, একাত্তরের ৩ আগস্ট চট্টগ্রাম মুসলিম ইনস্টিটিউটে ইসলামী ছাত্রসংঘ আয়োজিত সভায় নিজামী বলেন, ‘পাকিস্তান আল্লাহর ঘর। সেনাবাহিনীর মাধ্যমে তিনি প্রিয় ভূমির হেফাজত করছেন। দুনিয়ার কোনো শক্তি পাকিস্তানকে ধ্বংস করতে পারবে না।’ ২২ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক একাডেমি হলে আল মাদানীর স্মরণসভায় নিজামী বলেন, ‘পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করতে শত্রুরা অস্ত্র হাতে নিয়েছে।’ তিনি পাকিস্তানের শত্রুদের সমূলে নির্মূল করার আহ্বান জানান। ৮ সেপ্টেম্বর প্রতিরক্ষা দিবস উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে ছাত্রসংঘের সভায় নিজামী বলেন, ‘হিন্দুস্তানের মূল ভূখণ্ডে আঘাত হানতে রাজাকার, আলবদররা প্রস্তুত।’ ১০ সেপ্টেম্বর যশোরে রাজাকারদের প্রধান কার্যালয়ে এক সুধী সমাবেশে নিজামী প্রত্যেক রাজাকারকে ইমানদারির সঙ্গে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘আল্লাহর পথে কেউ কখনো হত্যা করে, কেউ মারা যায়।’ এসব বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তিনি ছাত্রসংঘের সদস্য, রাজাকার ও অন্যদের মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের উসকানি ও প্ররোচনা দেন। ট্রাইব্যুনালস আইনের ৩(২)(এফ) ধারার সঙ্গে ৪(১) ও ৪(২) ধারায় এসব অভিযোগ গঠন করা হয়েছে।
১৫তম অভিযোগ:
একাত্তরের মে থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সাঁথিয়া পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ে রাজাকার ক্যাম্প ছিল। নিজামী প্রায়ই ওই ক্যাম্পে গিয়ে রাজাকার সামাদ মিয়ার সঙ্গে ষড়যন্ত্র করতেন, যার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়। এসব অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল ৩(২)(জি) ধারায় নিজামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন।
১৬তম অভিযোগ:
একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের প্রাক্কালে অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে আলবদর বাহিনী। দেশের বুদ্ধিজীবী শ্রেণীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস করার জন্য পরিকল্পিতভাবে আলবদর সদস্যদের দিয়ে এই গণহত্যা চালানো হয়। জামায়াতের তৎকালীন ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ ও আলবদর বাহিনীর প্রধান হিসেবে ওই গণহত্যার দায় নিজামীর ওপর পড়ে।
উল্লেখ্য, নিজামীর বিরুদ্ধে এসব অভিযোগকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা নিজামীর কাঙ্ক্ষিত রায় ফাঁসি দাবি করছেন। অপরদিকে নিজামীর বিরুদ্ধে সব অভিযোগ মিথ্যা ও বানোয়াট উল্লেখ করে তিনি নির্দোশ প্রমাণিত হবেন বলে দাবি জানান আসামিপক্ষের আইনজীবীরা।
Disclaimer:
This post might be introduced by another website. If this replication violates copyright policy in any way without attribution of its original copyright owner, please make a complain immediately to this site admin through Contact.
No comments:
Post a Comment