আবার নতুন মোরকে ফিরে আসবে ব্রাদারহুড




কেউ কেউ বলছেন, মিশরের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার সাথে সাথেই আরব বিশ্বের প্রকৃত ইসলামী আন্দোলন মুসলিম ব্রাদারহুডেরও মৃত্যুঘণ্টা বেজেছে। অনেকে আবার একধাপ এগিয়ে বলছেন, রাজনৈতিক ইসলাম বিদায় নিয়েছে। তবে  নিউইয়র্ক টাইমসে The Brotherhood Will Be Back শিরোনামে প্রকাশিত এক নিবন্ধে ব্রুকিংস ইন্সটিটিউশনের গবেষক ও লেখক শাদী হামিদ বলছেন ভিন্ন কথা।

গত জুলাইয়ে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আরব বিশ্বের প্রকৃত ইসলামী আন্দোলন মুসলিম ব্রাদারহুড এখন অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে। এই দলটির ওপর চরম নিপীড়ন চালানো হচ্ছে। এখন দলটির ব্যর্থতা, এমনকি রাজনৈতিক ইসলামের মৃত্যু নিয়েও আলোচনার ঝড় বইছে।



ব্রাদারহুডের মৃত্যুর আগেই তার মৃত্যুর সংবাদটি এভাবেই লেখা হয়েছে।



১৯৬৩ সালের দিকেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ম্যাফ্রেড হালপার্ন লিখেছিলেন রাজনৈতিক ইসলামের ওপর ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদ বিজয়ী হয়েছে। এর অর্ধশতাব্দী পর  ব্রাদারহুডের বিরোধীরা আশা করছেন যে প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসির অপসারণের সাথে সাথে শুধু একজন ব্যক্তিরই পতন ঘটেনি, বিশ্বব্যাপী একটি সংগঠনেরও বিদায় হয়েছে। তারা বলছেন, গণতন্ত্র ও ইসলাম একসাথে চলতে পারে না। এমনকি এমন অদ্ভূত কথাও বলছেন যে, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত মুরসিকে সেনাবাহিনী ছাড়া অন্য কোনোভাবে সরানোর উপায় ছিল না।  মুরসি ব্যর্থ হয়েছিলেন এবং লাখ লাখ লোকের সমর্থন নিয়েই তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। তিনি ছিলেন একগুঁয়ে, অযোগ্য এবং সবাইকে নিয়ে দেশ পরিচালনায় ব্যর্থ। কিন্তু এরপরে তার চেয়ে আরো বড় ধরণের ব্যর্থতাও দেখা যাচ্ছে। এই মৌলিক ব্যর্থতা এই অঞ্চলকে আগামীতে দশকের পর দশক অচল করে রাখবে। সেটা হলো- গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে ইসলামপন্থীদের জায়গা করে দেয়া।



আমেরিকা উদারপন্থা ও গণতন্ত্রকে সহায়ক হিসেবে দেখে থাকে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের ব্যাপারটি আলাদা। সেখানে গণতন্ত্রায়ন হলে ইসলামপন্থী দলগুলো অনুদার হবে বলে বলে আশঙ্কা করা হয়।

রক্ষণশীল ধর্মীয় সমাজে ধর্ম ও রাজনীতিকে মেশানোর প্রতি জনগণের বিপুল সমর্থন রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ মিশরের নির্বাচনী তথ্যেই দেখা যায় যে সেখানকার বেশিরভাগ লোক স্পষ্টতই আইনের প্রাথমিক উৎস হিসেবে শরীয়াকেই পছন্দ করেন। এটিই যদি জনদাবি হয়, তবে কাউকে না কাউকে তো এটা সরবরাহ করতে হবেই। অধিকন্তু গণতন্ত্র মানে হচ্ছে, ইসলামে বিশ্বাসীদের ওপর শুধু ব্রাদারহুডের মত দলের একচ্ছত্র অধিকার আর নেই। তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছে নবগঠিত সালাফি পার্টি। তারা আরো কঠোর ইসলামী অনুশাসনে বিশ্বাসী। এখানে মধ্যডানপন্থী দলগুলোও ডানপন্থার দিকে ঝুঁকছে।



এটা পশ্চিমা পর্যবেক্ষকদের নিকট এই কণ্টকাকীর্ণ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছে যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উদারপন্থী হওয়ার অধিকার কী তাদের নেই? যেমন আরব বসন্তের অধুনা হতাশার ক্ষেত্র তিউনিশিয়ার বিষয়টির এখনো সুরাহা হয়নি। বিরোধীদের বিক্ষোভের মুখে স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার জন্য দেশটির ইসলামপন্থী এন্নাহাদা পার্টি প্রশংসার দাবিদার। তিউনিশিয়ার আসল পরীক্ষা এখনো শুরু হয়নি। সেখানে এন্নাহাদা পার্টি আবার নির্বাচনে জয়ী হয়ে যদি ইসলামী এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে তখন ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা কি সেটা গ্রহণ করবেন? গণতান্ত্রিক উত্তরণের ভঙ্গুর সময়টাতে এন্নাহাদা হয়তো দেশকে বিভক্ত করতে চায়নি। এর মানে এই নয় যে তারা তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য (ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম করা) থেকে সরে গিয়েছে। সর্বোপরি তারা তো ইসলামপন্থী।



কঠোর ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে ইসলামপন্থীরা তাদের ইসলামী বিশ্বাস পুরোপুরি প্রকাশ করতে পারেন না।  আবার কল্পিত ইসলামী গণতন্ত্রেও ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা বিচ্ছিন্ন বোধ করেন। এন্নাহাদার নেতা রাচিত গানুচি তরুণ বয়সে ফ্রান্সে যখন গ্রাজুয়েট শিক্ষার্থী ছিলেন তখন এমনটাই অনুভব করেছিলেন। তিনি তার ডায়রিতে লিখেছেন, ‘প্যারিসে যে এক বছর সময় আমি ছিলাম সেটাই ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন ও সবচেয়ে কষ্টকর সময়’। ইসলামপন্থীদের ধ্যানধারণা সততার সাথে গভীরভাবে ভেবে দেখার সময় এসেছে। ইসলামী আন্দোলনের একটি সুষ্পষ্ট বিশ্ব দৃষ্টিভংগী রয়েছে। তাদের রয়েছে সমাজকল্প।



আরবে সেক্যুলারপন্থীদের সমস্যা হচ্ছে যে মূলধারার ইসলামপন্থী দলগুলো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ। নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে তারা কখনোই গণতন্ত্রের গলা টিপে ধরেনি। ব্রাদারহুডের মত ইসলামী দলগুলো নমনীয়তার সাথে ইসলামী আইন নিয়ে অগ্রসর হয়েছে। ১৯৬০ ও ৭০-এর দশকে তারা যদিও বলতো যে গণতন্ত্র বিদেশি পণ্য, তবে সেখান থেকে তারা এখন অনেক সরে এসেছে।





ইসলামপন্থীদের এই অবস্থানে অনেকেই খুশি হতে পারেননি। তারা এটাকে তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হিসেবে দেখছেন। এটা হচ্ছে জিরো-সাম লড়াই, যেখানে একপক্ষ জিতলে অন্যপক্ষ হেরে যায়। তখন অন্য বিকল্প হচ্ছে ইসলামপন্থীদের কোণঠাসা করে রাখা অথবা তাদের ধ্বংস করে দেয়া।  মিশরের বর্তমান সেনা-সমর্থিত শাসকরা ঠিক এটাই করার চেষ্টা করছেন। এ ধরণের পদক্ষেপের পক্ষে অনেক লোকের সমর্থন থাকলেও তা শুধু রক্তক্ষয় এবং অস্থিতিশীলতাই বয়ে আনবে না, বরং এটা হলো চরম নির্বুদ্ধিতা। আপনি একটি সংগঠনকে শেষ করে দিতে পারেন, কিন্তু একটি বিশ্বাসকে হত্যা করা একেবারেই ভিন্ন কথা। আরব স্বৈরশাসকরা মনে করছেন যে অতীতে ইসলামপন্থী বিরোধীদের দমনে যথেষ্ট শক্তি প্রয়োগ করা হয়নি বলেই তাদের দমন-অভিযান ব্যর্থ হয়েছে। এবার তাই মিশরের দমনপীড়নে উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলো শত কোটি ডলার সহায়তা দিচ্ছে। এটা এ অঞ্চলের ইসলামপন্থীদের জন্য সম্ভবত কঠিন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। কিন্তু এই প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হবে।



আরব বসন্তের শিক্ষা এই নয় যে ইসলামপন্থী দলগুলো গণতন্ত্রের শত্রু। বরং লক্ষণ যা দেখা যাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে যে তাদেরকে ছাড়া গণতন্ত্র অসম্ভব। যখনই গণতন্ত্রের সূচনা হবে, হোক তা ৫, ১০ কিংবা ১৫ বছর পরে, তখনই ইসলামপন্থীদের হয়তো ভিন্নরূপে দেখা যাবে। তখনও তারা থাকবেন, রাজনীতিতে আধিপত্যের জন্য প্রস্তুত হবেন তারা, হয়তো আরো বেশি শক্তি নিয়ে।




Disclaimer:

This post might be introduced by another website. If this replication violates copyright policy in any way without attribution of its original copyright owner, please make a complain immediately to this site admin through Contact.

No comments:

Post a Comment