বাগদাদ বললে এখন আর আলিফ লায়লাখ্যাত খলিফা হারুন অর রশিদ আমলের সুখ আর সমৃদ্ধির প্রতিশব্দ বোঝায় না। বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ স্থানগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছে কিংবদন্তির এই নগরীটি। ইরাকে গণতন্ত্র আর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সাদ্দাম হোসেনকে হটিয়েছিল মার্কিন নেতৃত্বাধীন পাশ্চাত্য বাহিনী। সাদ্দামকে তারা ফাঁসিও দিয়েছিল। কিন্তু গণতন্ত্র কিংবা মানবাধিকার- কোনোটারই দেখা মেলেনি সেখানে। পরিস্থিতি বরং আগের চেয়েও খারাপ হয়েছে। হত্যা, হানাহানি, নির্যাতন এখন সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে সুন্নিদের বিরুদ্ধে চলছে নজিরবিহীন তাণ্ডব। দুবাইভিত্তিক আল জাজিরার সংবাদদাতা ইমরান খান এমনই একটি কাহিনী তুলে ধরেছেন। এই কাহিনীর নায়ক ফিরাজ। তবে এটি তার প্রকৃত নাম নয়। তিনি যাতে নতুন করে কোনো বিপদে না পড়েন, সে জন্য তার আসল নামটি গোপন রাখা হয়েছে।
বাগদাদের আদামিয়া মহল্লার ওপর রাতের কালো চাদর নেমে এসেছে। তবে মহল্লার প্রধান চত্বরটি তাতে বরং প্রাণ ফিরে পেয়েছে। ক্যাফেতে একদল তরুণ সমবেত হয়েছে। কেউ ‘নারগিলা’ টানছে, কেউ পাশা খেলছে। কেউ কেউ ছোট্ট একটা ফুটবলে লাথি দিচ্ছে, পরে আছে প্রিয় দলের গেঞ্জি।
চত্বরটির ঠিক পরেই আবু হানিফা মসজিদ। বাইরে যারা রিলাক্স করছে, তাদের কাছে মসজিদটির জাকালো ও জৌলুসময় অবয়বটি উষ্ণতা ছড়াচ্ছে।
বাগদাদে যে ভয়াবহ সহিংসতা চলছে, তা থেকে আদামিয়া রক্ষা পেয়েছে। অনেকেই রাতের শীতলতা কিংবা বন্ধুদের সাথে কিছুটা সময় কাটাতে এখানে আসেন, এখানকার নিরাপদ পরিবেশ উপভোগ করেন।
তবে সবাই এমনটা করতে পারেন না। এ কারণেই মসজিদের ভেতরে থাকা একটা লোক বাইরে আসতে ভয় পাচ্ছেন। আমি তার কাছ থেকে ৩ অক্টোবরের কাহিনী শোনার জন্য মসজিদের ভেতরে গেলাম।
ফিরাজ সে দিন তার বাড়িতেই ঘুমিয়ে ছিলেন।
‘হঠাৎ করে প্রচণ্ড শব্দ আর লোকজনের চিৎকার শুনতে পেলাম। তখন রাত ২টা। আমাদের রুমে আমি ছাড়াও ছিলাম আমার স্ত্রী ও সন্তানেরা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সৈন্যরা চলে এলো। তারা আমাকে আর আমার স্ত্রীকে ঘুষি দিতে লাগল। ঘরের কোনে বসে থাকা আমার সন্তানেরা ভয়ে কাঁদছিল। তারা আমাকে লাঠি দিয়ে পেটাল।’
‘আমাকে তারা টেনে ঘর থেকে বের করল। আমার পরনে তখন মাত্র আন্ডারওয়্যার। আমাকে একটা পিকআপে ছুড়ে ফেলা হলো। আমাকে বাগদাদ বিমানবন্দরের কারাগারে নেয়া হলো। আমার সাথে ছিল ৭০ বছর বয়স্ক এক পঙ্গু লোক। আমাদের কেন এখানে আনা হয়েছে, তা আমি বা ওই লোক- কেউ জানতো না।’
নরকে তিন দিন
ফিরাজ বলেন, তাকে কারাগারে নির্যাতন করা হয়েছে। তিনি জানান, তার আটককারীরা তাকে নিয়মিত পেটাত, তাকে খাবার বা পানি দিত না।
‘তিন দিন নরকে থাকার পর তারা চোখ বেঁধে আমাকে ভিন্ন একটি স্থানে নিয়ে গেল। অভিযোগ করল, আমি কোনো একটা সন্ত্রাসী সংগঠনের সাথে জড়িত। একপর্যায়ে বলল, আমি নাকি আল কায়েদার সদস্য।’
ফিরাজ বলেন, সুন্নি হওয়ার কারণে তাকে ধরে আনা হয়। ইরান শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। আর আল কায়েদার মতো সুন্নি গ্রুপগুলো সেখানে তাণ্ডব চালাচ্ছে।
তিনি প্রথমে আটক হয়েছিলেন ২০০৬ সালে, আমেরিকান বাহিনীর হাতে। তখন ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা চলছিল। তাকে কোনো ধরনের অভিযোগ ছাড়াই দুই বছরের জন্য আটক রাখা হয়। মুক্তির পর তাকে আবার আটক করা হয়। এ আল কায়েদার মোকাবেলায় সুন্নি ইরাকি মিলিশিয়া বাহিনীর হয়ে কাজ করার জন্য তাকে আট মাস আটকে রাখা হয়। তিনি জানান, আবারো কোনো অভিযোগ ছাড়াই তাকে মুক্তি দেয়া হয়।
‘আমি তরুণ সুন্নি। সম্ভবত কেবল এই কারণেই তারা আমাকে গ্রেফতার করছে।’
আমেরিকানদের প্রত্যাহারের পর তারা সব নথিপত্র ইরাকি সরকারের কাছে হস্তান্তর করে। ফিরাজ বলেন, সরকার খুশি মতো আমাদের হয়রানি ও গ্রেফতার করার জন্য ওই সব নথিপত্র ব্যবহার করছে।
তিনি আরো জানান, সেনাবাহিনী ও পুলিশ ছাড়াও একটি বিশেষ সরকারি বাহিনী রয়েছে লোকজনকে গ্রেফতার ও জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য। অন্যান্য বাগদাদবাসীর মতো তিনিও এই ভুতুড়ে বাহিনীকে ‘ডার্টি স্কোয়াড’ হিসেবে অভিহিত করেন। এই বাহিনীর অবশ্য একটি সরকারি নাম আছে : কাউন্টারটেরিরিজম স্পেশাল ফোর্স। তারা সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কর্তৃত্বাধীন।
তিনি জানান, ৩ অক্টোবর আটক করার জন্য ডার্টি স্কোয়াড তাকে এক মাসের বেশি আটকিয়ে রাখে। তারপর কোনো অভিযোগ ছাড়াই মুক্তি দেয়। তিনি তার আটক করার ব্যাপারে কোনো কাগজপত্র তৈরি করছেন কি না এই প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, ‘না’।
সরকারি প্রতিক্রিয়া
ফিরাজকে আটকের ব্যাপারে আলজাজিরা ওই ইউনিটের সাথে যোগাযোগ করে। ওই বাহিনীর একটি সূত্র গোপনে জানায়, তারা আইন অনুযায়ী কাজ করে। তবে তারা কোনো নির্দিষ্ট ঘটনা সম্পর্কে কোনো প্রতিক্রিযা জানাবে না।
এই বাহিনী ইরাকি আইনবহির্ভূত কোনো কাজ করছেÑ এমন অভিযোগও তিনি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, আটক ব্যক্তিদের মাত্র চার দিন রাখা হয়। এরপর তাদের আইন মন্ত্রণালয়ের হাতে হস্তান্তর করা হয়।
ফিরাজের বক্তব্য প্রমাণ করার মতো কোনো কাগজপত্র নেই, তবে মসজিদে তখন উপস্থিত লোকজন তার কথা সমর্থন করেছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক গবেষক ইরিন ইভার্স বলেন, ফিরাজের মতো অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছেন আরো অনেকে।
ইভার্স বলেন, সন্ত্রাসপ্রতিরোধ বাহিনী নামে যে সংস্থাটি গঠন করা হয়েছে, সেটি আইনের তোয়াক্কা করে না। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, তাদের হাতে আটক করার কোনো প্রমাণপত্র থাকে না। আটক ব্যক্তিদের কোনো ধরনের বিচার ছাড়াই মুক্তি দেয়া হয়।
বাগদাদে আবারো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এটা দমন করা সরকারের কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে।
কিন্তু সেটা নাগরিক স্বাধীনতার দামে?
ফিরাজি বলেন, ইরাকে থাকার ইচ্ছা তার উবে গেছে।
তিনি বলেন, ‘আমি এখানে বাস করতে পারি না। আমি এই দেশ ছেড়ে যাচ্ছি। আমি ভাবি : আমি কি রাতে আমার বিছানায় থাকতে পারব, না কি কেউ ঘুম থেকে আমাকে টেনে নামিয়ে আনবে।’
Disclaimer:
This post might be introduced by another website. If this replication violates copyright policy in any way without attribution of its original copyright owner, please make a complain immediately to this site admin through Contact.
No comments:
Post a Comment