দেখছি খেলা, মিলছে না হিসাব




অতি পরিচিত এবং প্রিয় নগরীকে মাঝেমধ্যে অচেনা মনে হয়। এই নগরীতে পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের দিনগুলো পার করেছি। একটা সময়ে সকাল-সন্ধ্যা নগরীর বিভিন্ন অলিগলি এবং রাজপথে ঘুরে বেড়িয়েছি। সেই সব দিনগুলোতে কি আনন্দ পেয়েছি এই বয়সে এসে আর বলতে পারব না। কৈশোরের দিনগুলোতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল এলে খেলাধুলা করেছি একটা সময় বুঝেছি এগুলো ছিল মূল্যহীন। খেলাধুলা এখন পুরোপুরি ব্যবসায় পরিণত হয়েছে কিছুই করার নেই। মানুষের দক্ষতা বিক্রি করে অর্থ উপার্জিত হচ্ছে। শিল্প বলি, সৌন্দর্য বলি, ভালোবাসা বলি এসবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অর্থ আর এই অর্থ ছাড়া সব কিছুই মূল্যহীন। খারাপ লাগছে তবুও বলছি, বর্তমান সমাজে আমরা সবকিছুই অর্থমূল্যে পরিমাপ করি। ব্রাজিলের বিশ্বকাপ প্রতিযোগিতা চত্বরগুলো শুধু নয় এর বাইরে বৃহৎ দুনিয়াজুড়ে ফুটবলকে ঘিরে ব্যবসা-বাণিজ্যের মহোৎসব চলছে। ফুটবলের আবেগকে বিক্রি করে ব্যবসা-বাণিজ্যের রমরমা অবস্থা। বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে বিশ্বকাপের অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর পতাকা বিক্রেতা খুরশেদ বললেন বেচাকেনা খুবই ভালো। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর ভুল বোঝাবুঝি শেষ হয়ে গেছে। তবে এই গরমে যদি একটা তুফান আসত তাহলে অনেক পতাকা ছিঁড়ে যেত, উড়ে যেত এতে বিক্রি আরো বাড়ত। কি আশ্চর্য ব্যবসায়িক চিন্তা-ভাবনা। সবাই তার নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে ফুটবলকে দেখছে।

নগরীতে বছরের পর বছর বাস করেও আমরা কেউ কারো নই। নগরীতে আমরা সবাই বিচ্ছিন্ন এবং আলাদা-আলাদা। প্রত্যেকেই ব্যস্ত নিজেকে নিয়ে। ফুরসত নেই। তবে সারাজীবনের অঙ্কের সন্ধান পেয়েছেন তাদের কথা আলাদা। সাধারণ মানুষ শুধু তো মাথা নিচু করে, মুখ বুজে জীবিকার ঘানি টানতে টানতে ক্লান্ত এবং পরিশ্রান্ত। এই লড়াইয়ের শেষ নেই। শুধু নগরী নয়, দেশজুড়ে মাঝেমধ্যে। একেকটা জোয়ার আসে তাতে গা ভাসিয়ে দেই। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই কিছুসংখ্যক তাদের চিন্তা-ভাবনা নিয়ে সরে থাকেন। এটাকে জোয়ার বা ইস্যু যাই বলি না কেন এই উপলক্ষকে কেন্দ্র করে কিছুদিনের জন্য হলেও আমরা সবাই এক হই তখন সব পরিচয় ঘুচে যায়।
ব্রাজিল বিশ্বকাপকে ঘিরে এখন আমাদের সব উচ্ছ্বাস, আবেগ, আনন্দ, সফলতা ও ব্যর্থতার রাত-দিনগুলো অন্যরকম। খেলা দেখছি- কিন্তু হিসাব মিলাতে পারছি না। ফুটবলকে চিনতে পারছি না। আমরা সাধারণ ফুটবল আমুদে মানুষ শুধু নই- বিশেষজ্ঞ এবং বিশ্লেষকরা বড় চিন্তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। তাদের সুবিধা হলে তারা তাদের নিজস্ব অবস্থান থেকে যুক্তিতর্কের মাধ্যমে হরদম সরতে পারেন। আমরা সাধারণ মানুষরা কিন্তু বারবার ধাক্কা খাচ্ছি। কথা বলছি। কখনো মন খারাপ করছি প্রত্যাশার সঙ্গে মিল খুঁজে না পেয়ে।

বিশ্বকাপে ফেভারিটদের তালিকার শুষ্ক খাতাটা আপাতত বন্ধ রাখা ছাড়া উপায় নেই। প্রথম রাউন্ডেই কে কোথায় চলে যায় আঁচ করা মুশকিল। এরপর তো নকআউট রাউন্ড সেখানে তো স্বপ্ন আর স্বপ্ন ভঙ্গের আরো বড় খেলা অপেক্ষা করছে। ব্রাজিলের দ্বিতীয় খেলা দেখতে বসেছিলাম মেক্সিকোর বিরুদ্ধে অতীতের পরিসংখ্যান, দলগত শক্তি এবং বর্তমানের প্রেক্ষাপটের আলোকে ব্রাজিলকে এগিয়ে রেখে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি দেখলাম। নেইমার অস্কাররা পয়েন্ট ভাগাভাগি করে মাঠ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। ব্রাজিলের তৈরি এত সহজ সুযোগগুলো একটিও জালে প্রবেশ করেনি।

মেক্সিকোর গোলরক্ষক বলতে গেলে একাই মাঠে ব্রাজিলকে রুখে দিয়েছেন। যারা রাত জেগে খেলা দেখেছেন তাদের কাছে এটা একটা অসাধারণ অভিজ্ঞতা। খেলার আগে ভাবা হয়েছে ব্রাজিল এই খেলায় জয়লাভের মধ্যে দিয়ে পরবর্তী রাউন্ডে চলে যাবে। তা আর হয়নি- এখন অপেক্ষা করতে হবে। মেক্সিকো তাদের লক্ষ্য অনুযায়ী ব্রাজিলের সঙ্গে পয়েন্ট ভাগাভাগি করে বেজায় খুশি। দুনিয়াজুড়ে ব্রাজিলের অগণিত ভক্ত এবং সমর্থকরা মন খারাপ করেছেন। কিন্তু করার তো কিছু নেই। ব্রাজিলের তারকা খেলোয়াড়রা তো চেষ্টা করেছেন। কিন্তু বল তো জালে প্রবেশ করেনি। ভালো খেলেও গোল করতে পারেনি ব্রাজিল। সমর্থক এবং ভক্তদের সান্ত¡না ‘ব্যাডলাক’। রাশিয়ার সঙ্গে ১-১ গোলে ড্র করেছে দক্ষিণ কোরিয়া। আমাদের এশিয়ার প্রতিনিধি। যেটা আনন্দ দিয়েছে তাহলো দক্ষিণ কোরিয়া পুরো খেলায় লড়াই করেছে।

ফুটবল দলীয় খেলা। পুরোপুরি টিম গেম। এখানে দলগত বোঝাপড়া এবং সমন্বয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা প্রায়ই আবেগের বশবর্তী হয়ে ভাবি প্রিয় দলে অমুক অমুক তারকা আছেন আমাদের আর ধরতে পারবে কে! এই ধারণা সঠিক নয়। পর্তুগালের বিরুদ্ধে জার্মানি টিমগেম ছিল অসাধারণ। তারা মাঠে দেখিয়ে দিয়েছে কিভাবে দলকে দাপটের সঙ্গে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়। মাঠে জার্মানির এগারো জন খেলেছেন প্রাণ দিয়ে।
ফুটবলারদের বিরুদ্ধে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার অভিযোগ উঠেছে। জীবিকার জন্য সারা দুনিয়ার খেলোয়াড়রা বিভিন্ন লীগে খেলে থাকেন। প্রতিটি খেলায় নিজস্ব কৃতিত্ব দেখাতে পারলে তাদের দাম বাড়ে। এই ব্যক্তি কৃতিত্ব দেখনোর সবচেয়ে বড় অঙ্গন বিশ্বকাপ ফুটবল প্রতিযোগিতা। আর ব্যক্তি বড় হলে সমষ্টির খেলা ব্যাহত হতে বাধ্য। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা কি দেখতে পাচ্ছি না।

ফুটবলে এসেছে অবিশ্বাস্য পরিবর্তন। এখনকার ফুটবল অনেক বেশি ক্ষিপ্রগতি, অনেক বেশি সৌন্দর্য ও অনেক বেশি কলাকৌশপূর্ণ। এখনকার খেলোয়াড়রা সাধনার মাধ্যমে দৈহিক সীমাবদ্ধতাও অতিক্রম করে যাচ্ছেন। টিম স্পিরিট জয়ের জন্য অনেক বেশি কার্যকর বলে প্রমাণিত হচ্ছে। যতদিন মানব সমাজ থাকবে ততদিন ব্যক্তিগত মেধা ও প্রতিভার আলাদা মূল্য অবশ্যই থাকবে। কিন্তু যতদিন মানব সমাজের উন্নয়নের প্রশ্ন উঠবে ততদিন সমষ্টিগত বোঝাপড়া এবং উদ্যোগের ভূমিকাও থাকবে। এজন্য একজন প্রতিভাবান খেলোয়াড় একটি দলকে জয়ী করতে পারে না। ফুটবল আমাদের সে শিক্ষাই দেয়। ফুটবলের উৎসবের রংয়ে নিজকে রাঙান।





Disclaimer:

This post might be introduced by another website. If this replication violates copyright policy in any way without attribution of its original copyright owner, please make a complain immediately to this site admin through Contact.

No comments:

Post a Comment