ক্যাথলিক খ্রিস্টান বিশ্বের প্রধান ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস শীর্ষস্থানীয় ইহুদিবাদী পুরোহিতের হাতে চুমু খাচ্ছেন-এমন ছবি প্রকাশিত হওয়ার পর ক্যাথলিক ও অর্থোডক্স খ্রিস্টানরা পোপের এই পদক্ষেপের তীব্র নিন্দায় সোচ্চার হয়েছে।
খ্রিস্টানরা ইন্টারনেট-ভিত্তিক সামাজিক নেটওয়ার্কগুলোতে পোপের এই পদক্ষেপকে অশোভনীয় পদক্ষেপ বলে উল্লেখ করেছেন।
সম্প্রতি অধিকৃত ফিলিস্তিন সফরের সময় পোপ ফ্রান্সিস এক শীর্ষস্থানীয় ইহুদি পুরোহিতের দুই হাতে চুমু খান। আর অনেক খ্রিস্টান এ ঘটনার ব্যাপারে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে বলেছেন: এটা খ্রিস্টানদের জন্য লজ্জাজনক ও মাথা নতজানু করার মত ঘটনা।
ফ্রান্সিস নিজেকে বিশ্বে ‘শান্তি’র গুরু বলে দাবি করা সত্ত্বেও দখলদার ইহুদিবাদি ও শিশু হত্যাকারী শিমন পেরেজের সঙ্গে থেকে অধিকৃত ফিলিস্তিনে একটি অলিভ বা জলপাই গাছ রোপণ করেছেন। তিনি এমন সময় শান্তির প্রতীক হিসেবে এই চারাগাছ রোপণের মাধ্যমে মজলুম ফিলিস্তিনি জাতিকে পরিহাস করেছেন যখন ইহুদিবাদী দখলদাররা মুসলমানদের প্রথম কিবলার শহর বায়তুল মুকাদ্দাস অঞ্চলসহ ফিলিস্তিনের নানা অঞ্চলে জবরদখলের প্রথম দিন থেকে এ পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিনই ফিলিস্তিনিদেরকে তাদের মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত করার অন্যতম পন্থা হিসেবে তাদেরই জয়তুন বাগানগুলো ধ্বংস করে আসছে!
জর্জ মারিও বোর্গোগলিও থেকে পোপ ফ্রান্সিস
জর্জ মারিও বোর্গোগলিও তথা পোপ ফ্রান্সিস জন্মগ্রহণ করেছেন আর্জেন্টিনার বুয়েন্স আয়ার্সে। খ্রিস্ট ধর্ম তাত্ত্বিক স্কুলে পড়াশুনার আগে তিনি ছিলেন একজন কেমিক্যাল টেকনিশিয়ান এবং বেশ কিছুকাল নাইট ক্লাবেও সক্রিয় সদস্য! পাদ্রি হিসেবে তৎপরতা শুরু করেন ১৯৬৯ সালে ৩৪ বছর বয়সে। আর্জেন্টিনার সামরিক শাসকদের সহযোগী হিসেবে তিনি নাগরিকদের অপহরণ ও তাদের নির্যাতনের মত মারাত্মক অপরাধেও জড়িত ছিলেন।
ব্রিটেনের ‘দ্য মেইল অন সানডে’ নামক ম্যাগাজিন এ সম্পর্কে জানিয়েছে, জর্জ মারিও বোর্গোগলিও ১৯৭৬ সন থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত আর্জেন্টিনার সেনা-শাসনামলে নির্যাতন, অপহরণ ও অন্যান্য সংঘবদ্ধ অপরাধযজ্ঞে জড়িত ছিলেন এবং এইসব অপরাধের শরিক হিসেবে তারা বিরুদ্ধে আদালতে মামলাও দায়ের করা হয়েছে।
বেনিডিক্টের পরিবর্তে ফ্রান্সিস
বিশ্বব্যাপী পাদ্রিদের নানা ধরণের যৌন কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়া ও এইসব কেলেঙ্কারি ধামাচাপা দেয়ার ঘটনায় নিজের ভূমিকার বিষয়টিও ফাঁস হয়ে পড়ার প্রেক্ষাপটে পোপ ষোড়শ বেনিডিক্ট পদত্যাগ করায় কার্ডিনালরাও যারপরনাই বিস্মিত হয়েছিলেন; এমনকি তাদের অনেকেই ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন। ২৬৫ তম পোপের পদত্যাগ যে গির্জার অবিবাহিত পাদ্রিদের লাগামহীন যৌন লালসার পরিণতি ছিল তা এখন প্রায় সবার কাছেই স্পষ্ট।
পাশ্চাত্যের কোনো কোনো দেশে ক্রমবর্ধমান ধর্মহীনতা বা স্যেকুলারাইজেশনের প্রেক্ষাপটে ষোড়শ বেনিডিক্ট মানবীয় মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনার জন্য বড় বড় বক্তৃতা দিতেন। কিন্তু বাস্তবে তারা সহযোগীরাই মানবীয় মূল্যবোধ রক্ষা করতে ব্যর্থ হওয়ায় এই ব্যর্থতার দায় কাঁধে নিয়ে খ্রিস্টান বিশ্বের ধর্মগুরুর পদ ছেড়ে দেয়াকেই যথাযথ ভেবেছেন বেনিডিক্ট। কিন্তু ফ্রান্সিস ধর্মীয় নৈতিকতা রক্ষার সেই অবস্থানেও বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি এ সম্পর্কে খুব কমই কথা বলেছেন ও খুব কমই রক্ষণশীল নীতি গ্রহণ করেছেন। পোপ হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার কয়েক দিন পরই নৈতিক চরিত্র বিষয়ে তার অপ্রত্যাশিত অবস্থান পোপ পদে তার উন্নীত হওয়ার নেপথ্যের রহস্যটি প্রকাশ করে দেয়।
সমকামীদের প্রিয় বছরের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব পোপ ফ্রান্সিস !!
পোপ একাধারে যেমন ‘টাইম’-এর ‘ম্যান অব দ্য ইয়ার’ তেমনি তিনি ‘ম্যান অব দ্য হোমোসেক্সুয়াল’ও বটে!!!
কারণ পোপ হওয়ার পর ফ্রান্সিস বলেছেন, কোনো সমকামী যদি সৎ নিয়ত নিয়ে স্রস্টা বা ঈশ্বরকে চায় তাহলে তার বিষয়ে বিচার-বিবেচনা করার অধিকার আমার নেই! পাদ্রিদের সমকামীতা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে ব্রাজিল থেকে রোম সফরের সময় তিনি এই জবাবই দিয়েছিলেন। সমকামীদের বছর হিসেবে ঘোষিত বছরটিতে ফ্রান্সিসের এই ঘোষণা থেকেই বোঝা যায় কেন তাকে পোপের পদে বসানো হয়েছে। বিশ্বব্যাপী সমকামীতাকে বৈধতা দেয়া, বিশেষ করে ধর্মীয় অঙ্গনেও একে বৈধতা দেয়ার জন্য ফ্রান্সিসের চেয়ে যোগ্য আর কে হতে পারেন?
নীতিবাদী খ্রিস্টানরা মনে করেন খ্রিস্ট ধর্মের কথিত মূল্যবোধ ও নীতি-নৈতিকতার সঙ্গে ফ্রান্সিসের পরিহাস এখানেই শেষ হয়নি। ফ্রান্সিস বলেছেন, “খ্রিস্ট ধর্মের অনেক শিক্ষাই সেকেলে হিসেবে রহিত হয়ে গেছে, তাই এইসব নীতির ব্যাপারে নতুন করে ভাবতে হবে!”
“গির্জা কোনো কোনো নৈতিক বিষয়ে সঠিক আচরণ করেনি। তাই এখন সে বিচারকের পদটি ছেড়ে দিয়ে নিজের হাত উদার চিত্তে সবার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে। এখন সমকামী, বহুকামী, লিবারেলিস্ট, রক্ষণশীল, (নাস্তিক্যবাদী) কমিউনিস্ট ও গর্ভপাতের সমর্থকরাও পোপের আশীর্বাদ পাবেন! কারণ, এরা সবাই প্রভুকে ভালবাসেন এবং আমাদের সবাইকে একই প্রভুর উপাসনা করতে হবে।”
ফ্রান্সিস আরো বলেছেন: “ক্যাথলিক গির্জা এখন আর জাহান্নাম বা নরকে বিশ্বাস করে না। কারণ, বিষয়টি প্রভুর প্রেমের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং আদম ও হাওয়ার ঘটনা কল্পকাহিনী ছাড়া আর কিছুই নয়। ... আমরা চিন্তা ও প্রার্থনার মাধ্যমে কিছু নতুন বিশ্বাস অর্জন করেছি। এ ছাড়াও স্রস্টা বিচারক নন, বরং তিনি মানবজাতির বন্ধু মাত্র ... কারো বিচার করার ইচ্ছা প্রভুর নেই! নরক আসলে মানুষের আত্মার একাকীত্বের অর্থবোধক রূপক শব্দ মাত্র।”
ফ্রি ম্যাশনারি চক্রের মত আন্তর্জাতিক কিছু নেটওয়ার্ক বিংশ শতকের শুরুর দিকে ধর্মগুলোকে ধর্মনিরপেক্ষ করাসহ মানুষের মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতা বা ধর্মহীনতা ছড়িয়ে দেয়ার জন্য গোপন কর্মসূচি নিয়েছিল। এখন দেখা যাচ্ছে খ্রিস্টিয় সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান পোপ পর্যন্ত ইহুদি ধর্মের সমর্থক হওয়ার দাবিদার তথা ইহুদি ধর্মের বেশভূষাধারী ধর্মনিরপেক্ষ জায়োনিস্ট বা ইহুদিবাদীদের সমর্থন করছেন এবং খ্রিস্ট ধর্মের বিশ্বাসগুলোকে বিকৃত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন।
ইতিহাস-সচেতন একদল বিশ্লেষক মনে করেন, যুগে যুগে শয়তানপূজারী একটি প্রভাবশালী মহল ধর্মগুলোর প্রকৃত রূপ বিকৃত করার জন্য নানা আধ্যাত্মিক মতবাদ চালু করেছে। এ জন্য তারা প্রাচ্যের বৌদ্ধ-থিওসফিস্ট কার্যক্রমকেও ব্যবহার করছে যাতে তথাকথিত ইহুদিবাদী পুঁজিপতি শয়তানপূজারী চক্রের কর্তৃত্ব বিশ্বব্যাপী জোরদার হয়।
কার অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করছেন পোপ?
জাতিসংঘ বর্তমানে ‘সামাজিক সহাবস্থান ও শান্তি শিক্ষা’ শীর্ষক কর্মসূচি নিয়ে তিনটি ঐশী ধর্মের মধ্যে বিরোধ মীমাংসার কাজ শুরু করেছে। কিন্তু এ জন্য ধর্মীয় আইনের কিছু নীতিমালা যা সমকামিতার মত পারিবারিক মূল্যবোধ বিরোধী তৎপরতার নিন্দা জানায় তা উচ্ছেদের পদক্ষেপ নিয়েছে এই বিশ্বসংস্থা। পোপের পক্ষ থেকে নরঘাতক ইহুদিবাদী ও সমকামীসহ ধর্মবিরোধী নানা গোষ্ঠীর প্রতি সমর্থন আসলে ধর্মের নামে বিশ্বকে ধর্মহীন করারই ষড়যন্ত্রের অংশ।
ধর্মীয় সফর না রাজনৈতিক সফর?
পোপ টুইটারে নিজের বার্তায় বলেছিলেন তিনি এক ধর্মীয় সফরে জেরুজালেম বা বায়তুল মুকাদ্দাস শহরে যাচ্ছেন। আর এ জন্য তিনি অনুসারীদের দোয়াও চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি সেখানে দেখা করেছেন ফিলিস্তিনিদের ওপর গণহত্যার পরিচালক নেতানিয়াহুর সঙ্গে এবং ইহুদিদের মতই তাদের প্রথা অনুযায়ী উপাসনা করেছেন। পোপ ইহুদিদের কুসংস্কারের অনুসরণ করে তাদের কথিত পবিত্র দেয়ালের ভেতরে একটি লিখিত কাগজ গোপন করেছেন!
এ ছাড়াও কথিত ধর্মীয় সফরের নামে অধিকৃত ফিলিস্তিনে গিয়ে পোপ বিতর্কিত হলোকাস্ট স্মৃতি-চিহ্ন পরিদর্শন করেন ও সেখানে প্রার্থনাও করেন! এই প্রথম খ্রিস্টান জগতের কোনো পোপ বিতর্কিত হলোকাস্ট জাদুঘর বা স্মৃতি-চিহ্ন পরিদর্শন করেছেন এবং উনবিংশ শতকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ইহুদি ধর্মকে ব্যবহারের পথিকৃৎ তথা ইহুদিবাদের ভিত্তিতে অবৈধ ইসরাইল প্রতিষ্ঠার রূপকার থিওডোর হার্ৎজেলের কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেছেন ও তার প্রশংসা করেছেন! তিনি কথিত শান্তি আলোচনা আবারও শুরু করতে নেতানিয়াহু ও ফিলিস্তিনি নেতা মাহমুদ আব্বাসকে আগামী মাসে ভ্যাটিকানে আসার আমন্ত্রণও জানিয়েছেন।
আমেরিকার মধ্যস্থতায় শুরু-হওয়া ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের মধ্যে মৃতপ্রায় আলোচনা গত মাসে পুরোপুরি ভেঙ্গে যায়। ইসরাইল মুসলমানদের প্রথম কিবলা দখলে রাখাসহ অবৈধ ইহুদি বসতি বিস্তার অব্যাহত রাখার ওপর জোর দিচ্ছে। এ ছাড়াও তেলআবিব ফিলিস্তিনিদের ওপর দমন-পীড়ন অব্যাহত রাখায় এবং ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের ফিরে আসার দাবি নাকচ করে আসায় আপোষ আলোচনায় অচলাবস্থা দেখা দেয়।
(তেহরান রেডিও/এসএ/২৯)
Disclaimer:
This post might be introduced by another website. If this replication violates copyright policy in any way without attribution of its original copyright owner, please make a complain immediately to this site admin through Contact.